মালয়েশিয়ায় যেভাবে কাটে প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের রমজান

পবিত্র মাহে রমজান চলে এলো। বরকতময় এ মাসের ফজিলত আহরণে ব্যস্ত সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। মহিমান্বিত এই মাস ঘিরে পুরো মুসলিম জাতির প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন তখন মালয়েশিয়াতেও প্রবাসী মুসলিম শিক্ষার্থীরা রমজান পালনে প্রাণোচ্ছল।
রমজান উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোনো ছুটি না থাকলেও ইফতার, সাহরি আর ইবাদাতে কমতি থাকে না মালয়েশিয়ান ইসলামিক সংস্কৃতিতে। পড়াশোনা, পরীক্ষা, নিয়মিত ক্লাস এসবকিছুর পাশাপাশিই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পালিত হয় মুসলিম শিক্ষার্থীদের রমজান।
মালয়েশিয়ার শহরগুলো বাংলাদেশের মতো মসজিদের শহর নয়। অনেক দূরে দূরে থাকে মসজিদ। তবে প্রতিটি মসজিদই মুসল্লিতে ভরপুর থাকে। সারা বছরই কমবেশি এরকম চিত্রই থাকে। যদিও রমজান মাস এলে মসজিদগুলোতে শুরু হয় ভিন্ন আমেজ। বলা যায় রমজান মাসে যেন মালয়েশিয়ায় মসজিদভিত্তিক এক সৌহার্দ্যের সমাজব্যবস্থা নেমে আসে সর্বত্র।
শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নামাজের সময়গুলোতে মসজিদে ইবাদতে মগ্ন হয়। নামাজের আগে বা পরে দলবেঁধে শিক্ষার্থীরা পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতে মগ্ন হয়। ইফতারের সময় সকলে মিলে একসঙ্গে ইফতারে যোগ দেওয়া এটি মালয়েশিয়ানদের অনন্য সংস্কৃতি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও চলে এই চর্চা।
রমজানে মালয়েশিয়ার প্রতিটি মসজিদ একেকটি মেহমানখানায় রূপ নেয়। প্রায় অধিকাংশ রোজদার মসজিদে ইফতার করতে আসেন। শুধু ইফতার করতে আসেন তা নয়, বরং যার বাড়ি যা যা রান্না হয়েছে এবং সেটি যে পরিমাণই হয়ে থাকুক না কেন তা নিয়ে চলে আসেন মসজিদে; সকলের সঙ্গে মিলে-মিশে ইফতার করবে বলে।
ইফতারির পদে পরিলক্ষিত হয় মালয়েশিয়ানদের খাবারের আভিজাত্য। বাহারি রকমের পিঠা, নানান পদের তরকারি, খিচুরি, ভাত, মাছ, আর যতো ফল-ফলাদি। থাকে নানান ফ্লেভারের হোম-মেইড জুস বা শরবত।
প্রবাসী শিক্ষার্থীরা যেহেতু সবাই ফ্যামিলিসহ থাকে না সুতরাং এরা বাড়ি থেকে রান্না করে সকলের জন্য কিছু নিয়ে না গেলেও অন্যান্যদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো সকলের সঙ্গে মিলেই ইফতারে যোগ দেয়। কেউ কেউ হয়ত খেজুর, পানি বা বিভিন্ন ফলমূল কিনে যুক্ত হয়। মসজিদগুলোতে ইফতারের এই আতিথ্য চলে সারা রমজান জুড়েই।
তারাবির নামাজে প্রতিটি মসজিদে থাকে উপচেপড়া ভিড়। কোনো কোনো মসজিদে ৮ রাকাত, এবং বেশি সংখ্যক মসজিদে ২০ রাকাত জামাতের সাথে তারাবিহ পড়া হয়। খতম তারাবিহ যদিও এখানের কোনো মসজিদেই হয় না, তবুও প্রতিটি মসজিদে ইমাম সাহেবের সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াতে কখন যে ঘণ্টা দুয়েক কেটে যায় তা বুঝাই যায় না।
নামাজে চলে আবারও আপ্যায়ন। হালকা নাস্তা বা পানীয় নিয়ে হাজির হয় মুসল্লিরা। যার যার সামর্থ্যানুযায়ী নানানরকমের খাবার নিয়ে এসে মসজিদের সামনে নির্দিষ্ট টেবিলে খাবার সাজিয়ে নামাজে মগ্ন হন সবাই। নামাজের পূর্বে-পরে সেসব খেয়ে তৃপ্ত হয় মুসল্লিরা।
একজন শিক্ষার্থীর ইফতার ও রাতের খাবার প্রায় দিনই কোনো না কোনো মসজিদে হয়ে গেলেও সাহরিতে নিজে রান্না করে বা কোনো রেস্তোরাঁ থেকে কিনে খেতে হয়। কারণ ওই সময়টায় সবাই যার যার বাড়িতেই সাহরি সেরে নেয়।
শিক্ষার্থী যারা নিজেদের খাবার নিজেরাই রান্না করে খায় তাদের জন্যও সুবিধা রয়েছে। মালয়েশিয়ায় পুরো রমজান জুড়েই খাদ্যপণ্যে থাকে বিশেষ ছাড়। বিভিন্ন মেগামল ও সুপারশপগুলোতে গেলেই দেখা যায় পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন পণ্যে ব্যবসায়ীদের ছাড়ের প্রতিযোগিতা।
তবে সকল ইতিবাচক দিকগুলোর বৈপরীত্যও আছে। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ এই পবিত্র রমজানে থাকে উদাসীন। কখন ইফতার হচ্ছে, কখন সাহরি হচ্ছে তা নিয়ে যেন কোনোই তোয়াক্কা নেই। যেহেতু অভিভাকহীন স্বাধীন সমাজে চলাফেরা করছে তাই কোনো মেন্টরিং না থাকায় অনেকেই পবিত্র রমজান মাস পেয়েও এর তাৎপর্য বুঝতে পারে না। নেতিবাচক এইদিকগুলোকে শুধরে নেওয়ার এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া না করাই সময়ের দাবি। প্রবাসে বরকতময় এই মহিমান্বিত রমজান আমাদের জীবনের সার্বিক কল্যাণ নিয়ে আসুক।
লেখক: বশির ইবনে জাফর, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি পূত্রা, সাবেক ভিপি, মাহসা ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া।