গুহার ভাঁজে মহাকাব্য
খাড়া পাহাড়ের সামনে ছুটন্ত রথ। তাতে মহাভারতের কৃষ্ণ। যেনো এইমাত্র বেরিয়ে এলেন পাহাড়ের পেট থেকে। তার রথের সামনে পাথরে খোদাই গীতার উপোদেশ। পেছনের গুহায় কচ্ছপের বাড়িয়ে রাখা গলার মতো সরু প্রবেশ পথ।
অসংখ্য খাঁজ বহুভূজ গুহার দেওয়াল-ছাদে অগণিত তাক তৈরি করে রেখেছে। প্রতিটি পাথুরে তাক যেনো সযতনে গড়া প্রাকৃতিক মিউজিয়ামের গ্যালারি। কোথাও কোথাও মাথা নুইয়ে মসৃণ মেঝের সঙ্গে মিতালি গড়তে চাইছে নিরেট ছাদ।
নদীর মতো বাঁক খেয়ে গুহাটা এগিয়েছে লম্বায়। শেষ মাথায় পাথর কেটে সিঁড়ি। বেজায় খাড়া। পাশেই একটা ঝরনা। গর্জন তুলে পাথুরে দেওয়াল বেয়ে নামছে।
সিঁড়ি বাইতে শুরু করতেই দরদরিয়ে ঘাম ছুটলো। গুহার ছাদে ঝুলে থাকা পাথুরে চিলেকোঠায় একটা শিবলিঙ্গ। কালো পাথরের। গুহার মেঝে থেকে চোখে পড়ে না। এমনকি সিঁড়ি থেকেও নয়। খুপরি গুহার মতো জায়গাটাকে লোহার শিক দিয়ে আটকে রাখা।
গুহার সামনে কৃষ্ণ। আর ছাদ লাগোয়া এই ছোট্ট গুহায় শিবলিঙ্গ। এ ছাড়া মূল গুহার সবটা জুড়েই রামায়ণ। গুচ্ছ গুচ্ছ ভাস্কর্যে ত্রিমাত্রিক প্রদর্শনী। দৃশ্যের পর দৃশ্যে রামায়ণের কাহিনী চিত্র ফুটিয়ে রেখেছেন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিশ্বামিত্র, বিভীষণ, বানর রাজা সুগ্রীব, হনুমান। গোটা গুহাটাই যেনো রূপ নিয়েছে মহাকাব্য রামায়ণে। এই গুহার নাম তাই রামায়ণ গুহা।
সপ্ত কা- বা সাত খন্ডে-বিভক্ত রামায়ণ এই অতিকায় গৃহায় গুচ্ছ গুচ্ছ ভাস্কর্যে প্রদর্শিত। প্রথমেই দশরথের স্ত্রী কৌশল্যার গর্ভে রাম, সুমিত্রার গর্ভে যমজ সন্তান লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন এবং কৈকেয়ীর গর্ভে ভরতের জন্ম কাহিনী। পর্যায়ক্রমে বিশ্বামিত্রের কাছে রাম ও লক্ষ্মণের যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা, লাঙলের রেখায় বিষ্ণুপত্নী দেবী লক্ষ্মীর অবতার জানকী বা সীতাকে কুড়িয়ে পাওয়া, সয়ম্ভর সভায় ধনুকে গুণ টেনে তাঁকে রামের অধিকারের দৃশ্য। এভাবে পুরো পৌরাণিক গল্পটাই ফুটিয়ে রাখা।প্রাচীন ভারতের ধর্মচেতনার এ এক অনবদ্য প্রদর্শনী।
রামায়ণকে বলা হয় পৃথিবীর আদি মহাকাব্য। বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় (অনলাইন সংস্করণ) খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতককে এ উপাখ্যানের রচনাকাল অনুমান করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসে, রামায়ণের রচনাকাল ত্রেতাযুগ হিসেবে পরিচিত পৌরাণিক কাল। চতুর্দশ শতকে কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণকে বাংলায় অনুবাদ করেন। রামায়ণের অংশ বিশেষ অবলম্বনে মহাকবি মধুসুদন দত্ত রচনা করেন মেঘনাদ বধ কাব্য। প্রাচীন বঙ্গে পৌরাণিক ধর্ম ও দেব ভাবনা গ্রন্থে ড. শম্ভুনাথ কুণ্ডু প্রাচীন বঙ্গদেশের লেখমালায় পরিবেবিশত রামচন্দ্রের নানা কাহিনীর বিবরণ দিয়েছেন। রাবণের চিতা বাগধারাটি বাংলা ভাষায় চির অশান্তির আগুন আর মর্ম বেদনার প্রতীক হয়ে আছে।
রামায়ণ গুহার অবস্থান মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের উত্তরে, গমবাক জেলায়, বাতু কেভ পাহাড়ে। কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার বা কেএলসিসি থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। কেএল সেন্ট্রাল থেকে কমিউটার ট্রেনে এখানে আসতে ঘণ্টাখানেক লাগে। বাতু কেভই এদিকে লাস্ট স্টপেজ।
স্টেশনের পেছনেই পাহাড়, রামায়ণ গুহা। জনপ্রতি টিকিট পাঁচ রিঙ্গিত। কাউন্টারের সামনে ৫০ ফুট উঁচু বানর দেবতা হনুমানের মূর্তি। সামনের বাঁধানো চত্বর ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলেই বাতু কেভ।
পুরো চত্বরেই বানরের দাপট। ডাবের খোলের মধ্যে সরু হাত সেঁধিয়ে টেনে টেনে শাঁস খাচ্ছে এক বাচ্চা বানর। একটা ধাড়ি তেড়ে আসতেই ডাবের খোল ফেলে সরে গেলো ছোটটা। একটু দূরে বসে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া খোলটাই দেখছে। ধাড়িটার মতিগতি বুঝে ফের কাছে এলো। ওটা যখন খোলের ভেতর থেকে খাবলা দিয়ে তুলে আনা শাঁস মুখে পুরছে, তখন হাত ঢোকালো ছোটো বানরটা। ধাড়িটা কিছু বললো না। মিলেমিশে ডাবের শাঁস খেতে থাকলো ওরা।
আশপাশে আরো ক’টা বানর খাবার খুঁটছে। সদ্য ফেলে যাওয়া আইসক্রিমের বাটিতে মুখ ডুবিয়েছে একটা। আর একটা গভীর মনোযোগে কফির কাপ শুঁকছে। পেছনে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একতলা এক মন্দিরের কার্নিশে বসে আরো কয়েকটা। অলস সময় কাটাচ্ছে। দুটোকে তো মনে হলো নিজেদের মধ্যে মস্ত আলোচনায় মশগুল।
পাহাড়ের গোড়ায় স্থানীয় হস্তশিল্পজাত পণ্যের পসরা,শপ। আইসক্রিম আর কফিও আছে। কোনো রেস্তোরাঁতেই আমিষের কারবার নেই। মধ্যাহ্নভোজের জন্য নিরামিষ প্যাকেজ মিলছে। কলাপাতায় চার পদের সবজিসহ ভাত পাওয়া গেলো সাড়ে তিন রিঙ্গিতে। প্রাণ জুড়িয়ে দিলো পাঁচ রিঙ্গিতের ডাব।
হাত দশেক দূরে একটা বানর বসে আছে। ডাবের খোলটা গড়িয়ে দিতেই বুকে তুলে দে লাফ। হারিয়ে গেলো চোখের পলকে। বাতু কেভের অতিকায় মুরুগান মূর্তি এখান থেকেই নজরে আসছে।
লেখক পরিচিতি
জাকারিয়া মন্ডল। জন্ম দিনাজপুরের বিরামপুরে। বিরামপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক, নটরডেম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) এবং শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে স্নাতকতকোত্তর। নিউজ মিডিয়া, গবেষণা ও তথ্যচিত্র তার কর্মক্ষেত্র। গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবেও পরিচিতি আছে তার। পেশাগত দায়িত্ব ছাড়াও প্রায়ই পরিব্রাজক বেশে পথে নামেন। চষে বেড়ান দেশ, বিদেশ। কিংবদন্তি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতার সুতোয় গাঁথেন ভ্রমণের গল্প। প্রথম গ্রন্থের নাম ‘পাহাড়ের ভাঁজে মহাকাব্য। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বাড়ির পাশে তীর্থ’। তৃতীয়টির নাম ‘মেঘনা মায়ের কোলে’। সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে’ তার চতুর্থ গ্রন্থ। একাধিকবার মালয়েশিয়া সফর করে প্রবাসীদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে অনেক অনুসন্ধানি রিপোর্ট উপহার দিয়েছেন। পূর্ব ও পশ্চিম মালয়েশিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরে পাঠকদের উপহার দিয়েছেন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট। এনটিভি মালয়েশিয়ায় তিনি মেলে ধরছেন তার অভিজ্ঞতার ডালি।