কাজী মাহতাব সুমন- দুই বাংলায় আবৃত্তির ফেরিওয়ালা
তিন যুগ ধরে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলায়, দুই বাংলায়, দুই দেশে, কেন্দ্রে ও প্রান্তে, গ্রামে ও শহরে যিনি কবিতার শব্দ ফেরি করে ফিরছেন, তিনি শ্রোতা নন্দিত আবৃত্তিশিল্পী, কাজী মাহতাব সুমন। তাঁর এই আবৃত্তি চর্চা ও খ্যাতি তিনি নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দেশব্যাপি। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি আবৃত্তি শিক্ষক হিসেবেও সমানভাবে জনপ্রিয়। মননে, ধ্যানে আর চিন্তা জুড়ে তাঁর কেবলই কবিতা, কখনো গুনগুন করে, কখনো স্বর উঁচিয়ে। কথায় কবিতা, কবিতা নিয়েই কথা এভাবে কবিতায় জড়িয়ে আছেন দারূণভাবে আবৃত্তির কারিগর এ মানুষটি।
১৯৬৯ সালে নানাবাড়ি নোয়াখালী মাইজদির হরিনারায়নপুরে তাঁর জন্ম এবং কুমিল্লার দারোগাবাড়িতে পৈত্রিকনিবাস। সেখানে কেটেছে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য। ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়েছেন। '৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তবে তিনি আসক্ত কবিতায়। ভালোবাসেন লিখতে ও বলতে। আবৃত্তি চর্চাই তাঁর জীবনের ধ্যান।
বাংলাদেশের সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চার শুরুর দিকের কর্মী তিনি। তবে কেন্দ্রে আবর্তিত হয়ে না, কাজ করতে ভালবাসেন প্রান্তিক অঞ্চলে। ১৯৯২ সালে গঠিত কুমিল্লার প্রথম আবৃত্তি সংগঠন, আবৃত্তি সংসদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৯৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টানা একযুগেরও বেশি সময় তিনি এ সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি আবৃত্তি সংসদ, কুমিল্লার উপদেষ্টা হিসেবে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।
আবৃত্তি সংসদ, কুমিল্লা ছাড়াও চাঁদপুরের মতলব উপজেলার আবৃত্তি সংগঠন সনক ও কবিতাঙ্গনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই জড়িত তিনি। এছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস আবৃত্তি সংগঠন, নোয়াখালী আবৃত্তি একাডেমি , কণ্ঠসাধন চান্দিনা , ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটার আবৃত্তি বিভাগ, শানিত উচ্চারণ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপ্রাস, ধ্বনিচিত্র বিনির্মাণ পাঠশালা, বাক ব্যঞ্জনা, বাকশিল্প বিকাশ পরম্পরাসহ দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে আরও বেশ কিছু সংগঠনের সুচনালগ্ন থেকেই প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত । কবিতা আর আবৃত্তির ডাক পেলেই এই আবৃত্তিবিহ্বল প্রাণ ছুটে যান। দিন নেই, রাত নেই কবিতা নিয়ে যে কোনো আন্দোলন, যে কোনো আয়োজন করতে প্রস্তুত তিনি।
কাজী মাহতাব সুমন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের নির্বাহী পরিষদে যুক্ত আছেন ১৯৯৮ সাল থেকে। তিনি আবৃত্তি প্রযোজনায় নিরীক্ষাধর্মী কাজ করতে ভালোবাসেন। পুরাণ ও ইতিহাসকে ভিত্তি করে তাঁর দুটি পূর্ণাঙ্গ আবৃত্তি প্রযোজনা দেশে ও দেশের বাইরে বেশ আলোচিত। পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারত অবলম্বনে ‘প্রাকযুগে পুরোভাগে’এবং ধর্মগ্রন্থ ও মিথ অবলম্বনে ‘নুহের নৌকা’ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন মঞ্চে এবং ভারতের আগরতলা ও কলকাতায় চৌত্রিশবার মঞ্চায়িত হয়েছে । সম্প্রতি ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ শিরোনামে একটি প্রযোজনা ঢাকার বাইরে কুমিল্লা ও চাঁদপুরে মঞ্চায়িত হয়েছে। এছাড়াও ভারতের আগরতলায় এ প্রযোজনায় দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, আবৃত্তি শিল্পে অবদানের জন্য এই শিল্পীর ঝুড়িতে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু সম্মাননা। দেশে এবং দেশের বাইরে পাওয়া এসব স্বীকৃতির জন্য তিনি কাজ না করলেও এগুলো তাকে অনুপ্রেরণা দেয় বলেই জানান। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে হাইগ্রেড তালিকাভুক্ত এই আবৃত্তিশিল্পী অর্জন করেছেন জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা -২০১৩, প্রান্তিক অঞ্চলে আবৃত্তিচর্চার বিকাশে অবদানের জন্য পেয়েছেন চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী ইলিশ উৎসব সম্মাননা-২০১৬ এবং উর্বশী আবৃত্তিপদক-২০০৬, সিলেট ।
দেশের বাইরে অর্জন করেছেন ২০০৫ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সরকার প্রবর্তিত ভারতীয় সংবিধান প্রণেতা ডঃ বি আর আম্বেদকর পদক, ২০০৩ সালে পেয়েছেন ত্রিপুরা নজরুল একাডেমি সম্মাননা। বৃহত্তর কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের বেশির ভাগ আবৃত্তি সংগঠনগুলোই তার পরিচর্যায় বিকশিত হয়েছে। শুধু এই অঞ্চলে নয় সারাদেশেই তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট ও আর্টিস্টা একাডেমি অফ ফাইন আর্ট ঢাকার নিয়মিত প্রশিক্ষক এই গুণী শিল্পী তাঁর কথা ও কাজ দিয়ে নিজেকে করে চলেছেন বরণীয়। বর্তমান প্রজন্মের আবৃত্তি চর্চায় আগ্রহীদের অনেকেই ভালবেসে শ্রদ্ধায় তাকে 'গুরু' বলে মানেন।
তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে আবৃত্তির তিনটি অডিও এ্যালবাম। এগুলো হচ্ছে-ফিরে এসো চাকা, একুল ওকুল এবং শুধু তোমার জন্য । তিনি কবিতা লিখেন,তবে অনিয়মিত। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'দীর্ঘায়ূ স্বপ্নের কোলাজ’ নামে তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন আরও দুইটি কবিতা সংকলন ‘এপার ওপার’ এবং বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার কবিতা ‘সেতু’।
প্রকাশক ছিলেন জাভেদ হুসেন অনূদিত ধ্রুপদী উর্দু কবিতা ও ইসহাক সিদ্দিকির অনুবাদ 'দ্য মেটাফিজিক্স অব ইকবাল' গ্রন্থসহ আরও বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থের । এর মধ্যে আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর বিজয় দিবসে বাংলাদেশ সহকারী হাই কমিশন আগরতলার উদ্যোগে প্রকাশিত স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত দশটি বিখ্যাত কবিতার অডিও ভিজ্যুয়াল ট্র্যাক। ‘জয়বাংলার কাব্য’ শিরোনামে ভারতের আগরতলার শিল্পী শাওলী রায় ও বাংলাদেশের আবৃত্তিশিল্পী কাজী মাহতাব সুমনের যৌথ নিবেদন এই অডিও ভিজ্যুয়াল অ্যালবামটি ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছিলো।