মালয়েশিয়ার পাংকর দ্বীপ, ভ্রমণ প্রেমীদের এক স্বর্গরাজ্য
গাড়ির স্ক্রিনে থাকা ম্যাপটি বলছে আরো ঘন্টা দুয়েক লাগবে পৌঁছতে। এখন রাত তিনটা। ঘন্টায় একশত বিশ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে চলছে আমাদের গাড়ি। স্টিয়ারিং সিটে ওয়ালিউল্লাহ ভাই, পাশে আমি এবং পেছনে সোহান ও শাফিন। গন্তব্য ম্যারিনা আইসল্যান্ড এবং সেখান থেকে সূর্যদয় দেখতে দেখতে ফেরিতে করে যাবো পাংকর দ্বীপে।
দ্বীপটিতে প্রাইভেট বিচসহ অসংখ্য সৈকত রয়েছে। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ আর ঘন জঙ্গল দ্বীপটিকে করেছে নীল-সবুজের এক অপরূপ নিদর্শন।
ম্যারিনা আইসল্যান্ড যখন পৌঁছলাম তখন ভোরের আকাশ মেঘে আচ্ছাদিত। মালয়েশিয়ার আবহাওয়ার এই একটা চিরচেনা রূপ। এখানে মাত্র একটি ঋতু। সারা বছরই গরম এবং হুটহাট বৃষ্টি নেমে যায। ঝুম বৃষ্টির ঠিক ঘন্টাখানেক পর পরই এতো কড়া রোদ উঠবে যে আশপাশের কোথাও বৃষ্টির কোন নিশানাই থাকবে না। দেশটিতে এই একটিই অপূর্ণতা রয়ে গেছে যে এখানে শীত নেই। শীত থাকলে এটি ভ্রমণপ্রেমিদের স্বর্গরাজ্য হতে পারতো। যদিও এখনো তাদের বৈদেশিক মূদ্রার বড় একটি অংশ আসে পর্যটকদের থেকে। বলা হয়ে থাকে বৈদেশিক মূদ্রার প্রধান খাত পাম ওয়েল এর পরপরই পর্যটন খাতের অবস্থান।
সূর্যোদয় দেখতে না পাওয়া মনখারাপ নিয়ে জেটি ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় থাকলাম সবাই। এয়ারপোর্টের মতো করে সাজানো ফেরির টার্মিনাল, ল্যাগেজগুলো নিরাপত্তার স্বার্থে সিকিউরিটি স্ক্যানিং মেশিনে চেকিং হয়ে তারপর ফেরিতে যাচ্ছে। একটি টিকেটের মূল্য ১৫ রিংগিত। একই টিকেট দিয়ে দিনের যেকোন সময় ফেরত আসা যায়। প্রতি ঘন্টায় একটি করে ফেরি আছে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ। যদি এরচেয়েও বেশি দেরি হয়ে যায় তবে এই দিন আর আসা সম্ভব না। পরের দিন একই টিকেটে ফিরতে পারবেন।
আমরা যেহেতু জেটি ঘাটে গাড়ি পার্ক করে রেখে গেছি সুতরাং থাকার ইচ্ছা নেই। যদিও পাংকর দ্বীপে প্রচুর হোটেল রয়েছে। সমৃদ্র আর পাহাড়ঘেষা উপত্যকায় নান্দনিক ডিজাইনে সজ্জিত হোটেলগুলো পর্যটকদের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। তবে পরদিন যেহেতু আমাদের ক্লাস আছে। তাই একদিনের মধ্যেই নিয়মিত বের হওয়া সপ্তাহান্তের এই যাত্রাটি সম্পন্ন করার ইচ্ছা নিয়ে ফেরিতে উঠি।
ঘন্টাখানেকেরও কম সময়ে পাংকর উপকূলে পোঁছে যাই। সেখানকার নিরাপত্তা চেকিং সম্পন্ন করে টার্মিনাল থেকে বের হয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে আমরা রওয়ানা হই নীপাবিচের দিকে। ছোট-বড় অসংখ্য বিচের মধ্যে এই বিচটিই তুলনামূলক ফাঁকা থাকে এবং অত্যন্ত নিরিবিলি পরিবেশে সমূদ্রের গর্জন আর পাখিদের কোলাহল শোনা যায়।
পাহাড়ী ঘনজঙ্গল পেড়িয়ে আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছে যাই সৈকতে। বিদেশি পর্যটকের চেয়ে স্থানীয়রাই এই দ্বিপটিতে বেশি আসে। আসপাশে তাই স্থানীয়দের চলেফেরাই বেশি চোখে পড়লো। আমরা যখন সৈকতে নামলাম, ভোরের স্নিগ্ধতার রেশ তখনো বাকি। সূর্যের দেখা না পাওয়ায় সকালটাকে আরো বেশি ভোর মনে হচ্ছিলো। তবে সূর্যের কিরণ পেলে হয়ত অনেক বেশি সতেজতা ফিরে পেতো নীল সমূদ্রজলে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল পাহাড়গুলো।
কিছুসময় সৈকতে কাঠিয়ে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে যেয়ে সকালের নাস্তা সেরে নেই। মালয়েশিয়ায় খাবারের খরচ তুলনামূলক বেশি হলেও এখানকার খাবারে রয়েছে অনেক বেশি বৈচিত্র। একসময় মালয়েশিয়ায় নাবিকরা তাদের জাহাজ নোঙর করতো মশলা কিনতে। এখানে নাকি তখন মশলার খুব খ্যাতি ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকের কথা এটি। এখনো সেই রেশ কিছুটা আছে বলেই মনে হয়। দীর্ঘ তিন বছরেরও অধিক সময় থাকার পরও ওদের যে কতো রকমের খাবার আছে সেটিই আন্দাজ করা হয়ে উঠেনি। তাছাড়া থাই ও চাইনিজ খাবারেরও রয়েছে বিপুল সমাহার।
যেকোন জায়গায় গেলে নাকি সেখানকার স্থানীয় খাবার খেতে হয়। কিন্তু আমি কাকড়া, স্কুইড বা অক্টোপাস খাই না বলে এসবের কিছুই অর্ডার করিনি। চিংড়ি দিয়ে একটা ফ্রাইড রাইসের আইটেম অর্ডার করে দুপুরের খাবারের অর্ডার করে আসি। এখানকার নিয়ম হচ্ছে যেকোন খাবার কারা তৎক্ষণাৎ রান্না করে দেয়। তাই আগে থেকে অর্ডার করে গেলে সুবিধা হয়। খাবারের জন্য অনেকটা সময় নিয়ে বসে থাকার প্রয়োজন হয় না।
সকাল পেড়িয়ে যখন দুপুর গড়ালো, সূর্যেরও দেখা তখন মিললো। আর খুব অবাক করে লক্ষ্য করলাম সমূদ্রের নীল ফেনিল জলরাশি তার রং বদলাচ্ছে! নীল থেকে কালো রঙে বদলে গেছে পুরো সমুদ্র। বিকেল নাগাদ সেই জল আবার গাঢ় সবুজ হতে দেখেছিলাম।
দুপুরের খাবার খেয়ে কাছের একটি পাহাড় থেকে ঘুরে ফের সৈকতে নেমে এলাম। কখন যে সন্ধ্যার আবেশ নেমে নেমে এলো টেরই পেলাম না। মাথার উপর পাখিরা তাদের আপন নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে। আমাদেরও তখন ফিরতি পথ ধরতে হলো। সমুদ্রযাত্রার সেই অসাধারণ স্মৃতি নিয়ে আরো একটি নির্ঘুম রাত পেড়িয়ে আমরাও ফিরলাম আপন নীড়ে।
লেখক:
সেক্রেটারি, বাংলাদেশী স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশান মালয়েশিয়া (বিএসওএম)।
সাবেক ভিপি, মাসা বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া