বিশ্ব শ্রম বাজারে অশনি সংকেত: দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ার সম্ভাবনা

গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহর থেকে শুরু হওয়া নভেল করোনা ভাইরাস যা এখন কোভিড-১৯ নামে সারা বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করে জুলাই ২০২০ এর প্রথম সপ্তাহে বিশ্বে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাত মিলিয়নের অধিক, আর প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় চার লাখের বেশি। বিশ্বে এই সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান কোথায় পৌঁছাবে এবং কবে এই মহামারী থেকে বিশ্ববাসী অব্যহতি পাবে, তা এখনও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
এই মহামারিটি শুধু মানুষকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়নি, তার সাথে সাথে বর্তমান বিশ্বের প্রায় সাত শত কোটির অধিক মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা, আর্থ-সামাজিক সহ প্রায় সকল কর্মকান্ডকে স্থবির করে দিয়ে এক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমরা জানি যে অর্থিনীতির সকল সূত্র, তত্ত্ব, মডেল ও সংজ্ঞাগুলোর একটি সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সকল অবস্থা অপরিবর্তিত থাকতে হবে শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ও প্রয়োগ করা যাবে।
তা হলে আজ এবং আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব তথা বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির রূপরেখা কেমন হতে পারে, বিশেষ করে রেমিট্যান্স আয়ের উৎস হিসাবে বিশ্ব শ্রম বাজার অর্থনীতিকে সামনে রেখে সংক্ষিপ্ত আলোচনাই এই প্রবন্ধটির মৌলিক উদ্দেশ্য।গত একযুগ ধরে বাংলাদেশ গড়ে ৬.১৪ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। আর প্রবৃদ্ধির হারের স্থিতিশীলতা এ অঞ্চলের সব দেশের মধ্যে উত্তম। বিগত সাত বছরের গড় প্রবৃদ্ধি আরো ভালো, ৬.২৪%। সারা দুনিয়া জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও নানা মাত্রিক ঝুঁকি মোকাবেলা করেই বাংলাদেশের এগিয়ে যাবার ভঙ্গিটি প্রশংসিত হচ্ছে।
শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়ছে তাই নয়, এ প্রবৃদ্ধি সকলেই ভাগ করে নিচ্ছে। দ্রুত দারিদ্র্য নিরসনের হারই প্রমাণ করে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি খুবই গুণমানের। অতি দারিদ্র্যের হার প্রায় বারো শতাংশে নেমে এসেছে। এ বছর প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখা গেলে অতি দারিদ্র্যের এই হার অচিরেই এক ডিজিটে নেমে আসবে। এটা সম্ভব হচ্ছে আমাদের প্রবৃদ্ধির চালক কৃষি, রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক শিল্পের সমান্তরাল প্রসারের কারণে। এসবই কর্মসংস্থান-বর্ধক খাত। এ কারণে আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের মাত্রাও এখনো পর্যন্ত সহনীয় রয়েছে। বর্তমান সরকারের ‘ভিশন-২০২১’ জনগণের মৌলিক চাওয়াকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।
ব্যক্তি খাতের প্রাধান্য, উদারীকরণ ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি সংস্কার, বড় বড় অবকাঠামো গড়ার উদ্যোগ, দেশব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার এবং মার্কেটের সাথে অধিকহারে সংযুক্তির কৌশলের ওপর ভিত্তি করে এই দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এই কৌশল বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের নীতিমালা গ্রহণ করেছে। আর এমন কৌশল ব্যবহার করে বাংলাদেশ যেহারে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে তা বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের দ্বিগুণেরও বেশি। আর ঠিক সেই সময়ই এই বিশ্ব মহামারি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়ন সূচকে বিশ্বব্যাপী ঈর্ষণীয় অবস্থান প্রশংসিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়টি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে তার একটি শক্তিশালী হলো রেমিট্যান্স। বর্তমানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে বাংলাদেশ; এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। আর এই সমৃদ্ধির অর্থনীতি গড়তে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রতি বছর লাখেরও বেশি বাংলাদেশি নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এবং সেখানের ভিন্ন পরিবেশে কষ্টকর জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে। শুধু এই নয়, বিদেশে নির্মাণ শিল্প থেকে শুরু করে কৃষি জমিসহ বিভিন্ন স্থানে নিরলস পরিশ্রম করে হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাছে তারা। রেমিট্যান্স আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ ভাগ।
জাতীয় অর্থনীতির তাই অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিট্যান্স। মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচনালগ্ন থেকেই ছিল প্রধানত কৃষিভিত্তিক। বিগত কয়েক দশকে এ অর্থনীতি ব্যবসায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবসাকে পাল্টে ফেলেছে এ দেশের শ্রমিক ভাইবোনদের বিদেশ থেকে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর অনেক দেশেই কর্মী সরবরাহ করার মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে তা তাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে। এর ফলে অভিবাসী কর্মীদের পরিবারে যেমন ফিরে এসেছে সচ্ছলতা, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও উন্নয়নের প্রভাব পড়েছে। বলতে গেলে অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এসব দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মূলধন জোগানোর মূল উৎসে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে কয়েক বছরের কর্ম শেষে অর্থ ছাড়াও অভিবাসী কর্মীরা নিয়ে আসেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার আরেক মূলধন। যদিও তাদের প্রেরিত অর্থের ব্যবহার কারণে-অকারণে নানাভাবেই হয়ে যায়, কিন্তু তাদের কর্ম-অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজে লাগাতে পারে বা লাগানো হয় সে প্রশ্নের উত্তর খুব একটা সন্তোষজনক নয়।
একটি পরিকল্পিত রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনার অভাবে অভিবাসীদের প্রেরিত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হচ্ছে না বলে আমাদের অনেকের ধারণা। এত কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই ব্যয় হয়ে থাকে এমন সব খাতে, যেখান থেকে কোনো আর্থিক লাভ বা আয় আসে না। অর্থাৎ অনুৎপাদনশীল কাজে রেমিট্যান্সের ব্যবহার প্রাধান্য পায়। বিশ্বের কয়েকটি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা নতুন সম্পদ অর্জন ও স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক কর্মে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই রকমের চিত্র পাওয়া যায়।
সত্যি বলতে কী, অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স তাদের পরিবারের আয় বাড়ালেও সামগ্রিকভাবে তা দেশেরই প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে থাকে। তবে আমরা যা-ই বলি না কেন, এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে তা নির্ভর করে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, কর্মক্ষমতা এবং সার্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশের ওপর।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই নিম্নমুখী৷ তার মধ্যেও ভাল করছিল রেমিট্যান্স৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি৷ এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্যে৷ যেইসব দেশ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এরইমধ্যে কমে গেছে৷ সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনমত আয় করতে না পারলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবেন না৷ তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে৷ এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে৷
করোনার প্রভাবে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দামে ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন হয়েছে৷ শুধু চলতি বছর ৫০ ভাগ কমে অপরিশোধিত ব্রেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৩৩ ডলারে৷ এই পরিস্থিতি খবু সহসায় কাটবে এমন আভাস মিলছে না৷ কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীর হলে জ্বালানির চাহিদা এমনিতেই কমতে থাকে৷ অন্যদিকে তেলের উৎপাদন কমিয়ে বাজার সামাল দেয়ার বিষয়েও একমত হতে পারেনি সৌদি আরব ও রাশিয়া৷ এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের লোকসান গুণতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোকে৷ বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের বড় অংশটাই কিন্তু আসে এই অঞ্চল থেকেই৷
যদিও এই বৈশ্বিক মহামারিতেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। গত ২৮ মে পর্যন্ত ১৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশি মুদ্রায় (বিনিময় হার ৮৫ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ১১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের মে মাসের ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যা তার আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে প্রায় ২৫ কোটি ডলার বেশি। এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছিল ১০৮ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। যা গত ৩০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৮৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি বছরের মার্চ মাসে ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ কম। গত বছরের মার্চে রেমিট্যান্স আসে ১৪৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। করোনাভাইরাসের লকডাউনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা অনেক প্রবাসীর আয় বন্ধ হয়ে যায়।
আবার অচলাবস্থার কারণে অনেকে দেশে অর্থ পাঠাতে পারেননি। এসব কারণে গত দুই মাস রেমিট্যান্সের প্রভাব কমেছে। এখানে উল্ল্যেখ যে, ঈদের আগে প্রতি বছরই দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। গত বছরের ঈদের আগে মে মাসে ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এ বছর কিছুটা হলেও হোঁচট খেয়েছে।
অর্থাৎ ইতিমধ্যেই মহামারির নেতিবাচক প্রভাবে অতি দ্রুত রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বিশ্বব্যাপী এ বছর অভিবাসন ও কর্মসংস্থান কমে যাবে। আরো বলা হয়েছে, করোনার কারণে ভ্রমণে নিয়ন্ত্রণ আরোপের আগে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিদেশে থাকা শ্রমিকরা ফেরত এসেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের চলে যেতে বলেছে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্রবাসীদের বড় একটি অংশের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে। আর ইতালিতে বৈধ-অবৈধভাবে থাকেন প্রায় আড়াই লাখ। করোনা আতঙ্কে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বেশির ভাগ প্রবাসী।
অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ার অবস্থাও এখন খুবই প্রান্তিক পর্যায়ে। সেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকরা কার্যত কয়েক মাস ধরে অবরুদ্ধ। মূলত দেশের মোট রেমিট্যান্সের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এ চার দেশ থেকে আসে ১১ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আসে সোয়া ১২ শতাংশ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে প্রায় ৬০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ। সম্প্রতি এশিয়া প্যাসিফিকের দেশগুলোতে করোনার প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে এসব দেশে কর্মরত অনেক প্রবাসীই বাংলাদেশে চলে আসছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবে পড়তে পারে। একই সাথে মহামারির সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদি হলে এ খাতে অবস্থার আরো মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উল্লেখযোগ্য দুটি খাতই হচ্ছে তৈরী পোশাক শিল্প ও বৈদেশিক শ্রমবাজার। কিন্তু বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্ব-অর্থনীতিতে যেমন ছন্দপতন ঘটিয়েছে, ঠিক তেমনি আমাদের দেশের অর্থনীতিতেও সৃষ্টি করেছে বড় ধরনের বিপর্যয়। কাঁচামালের অভাবে এক দিকে পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অপর দিকে করোনাভাইরাসের হানায় প্রবাসীরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহে সৃষ্টি হয়েছে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য রীতিমতো উদ্বেগের। রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে৷
অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারবেন না৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে৷ কমে যাবে বেচাকেনা৷ চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে৷ সব মিলিয়ে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্যে৷ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি এরিমধ্যে বলেছে বাংলাদেশের জিডিপি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে এক দশমিক এক ভাগ কমে যেতে পারে৷ তাদের হিসাবে এতে মোট তিনশো কোটি ডলারের ক্ষতি হবে, আট লাখ ৯৪ হাজার ৯৩০ জন চাকুরি হারাবে৷
অবশ্য কিছু আশা করার মতো জায়গাও রয়েছে৷ জ্বালানি তেলের পুরোটাই বাংলাদেশ বিশ্ব বাজার থেকে কেনে ৷ দাম কমায় এখন আমদানি খরচ আগের চেয়ে অনেক কমে যাবে ৷ সরকার যদি বাজারে সে অনুযায়ী দাম সমন্বয় করে তাহলে শিল্পের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমবে ৷ এতে সাধারণ মানুষও উপকৃত হতে পারেন ৷ তবে সরকার জ্বালানি তেলে দাম না কমালে পুরো লাভটাই ভোগ করবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসি ৷ করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীন থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ বা কমিয়ে দিয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ৷ এর ফলে পোশাক খাতে বাংলাদেশের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৷ হংকংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে ৷ ২০০ টি আন্তর্জাতিক ক্রেতা কোম্পানির উপর এই জরিপটি চালানো হয়েছে ৷
প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে তারা চীনের বদলে এখন অন্য দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে ঝুঁকছে৷ যার মধ্যে ভিয়েতনাম, ভারতের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশও ৷ তবে করোনা ভাইরাস যদি বিশ্ব অর্থনীতিতেই গভীর প্রভাব ফেলে তাহলে এই সুবিধাগুলো বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে ৷
লেখক - অভিবাসন বিষয়ক গবেষক, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, মাইগ্রেশন রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট এন্ড সোসাইটি অফ বাংলাদেশ ৷