সিঙ্গাপুরে ‘রাষ্ট্রপতি পদক’ পেলেন বাংলাদেশের কবির হোসেন
সিঙ্গাপুরে সর্বোচ্চ সম্মানিত পুরস্কার ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের নাগরিক কবির হোসেন। শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভবন ইস্তানার বলরুমে সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট হালিমাহ ইয়াকুবের হাত থেকে অ্যাওয়ার্ডটি গ্রহণ করেন তিনি। তিন ক্যাটগরির মধ্যে ‘পিপল অব গুড’ ক্যাটাগরিতে তিনি এ অ্যাওয়ার্ডটি পান। খবর বিডিপ্রেস এজেন্সি।
শুক্রবার এ খবরে প্রকাশ পেলে সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনা উচ্ছাস দেখা মেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে।
তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় কবির হোসেন বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। সিঙ্গাপুর সরকার এতবড় সম্মান আমাকে দিবে এটা কখনো ভাবিনি। ভালো কাজ করলে অপ্রত্যাশিত ভাবে আরো ভালো কিছু পাওয়া যায় এটাই তার প্রমান।
সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সোসাইটির(এসবিএস) সভাপতি মোঃ হাফিজুর রহমান এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘কবির হোসেনের প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ডটি বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, আনন্দের ও গর্বের বিষয়। আমরা সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে তাকে আন্তরিক অভিন্দন জানাচ্ছি। আমরা তার খবরটি সকলের কাছে শেয়ার করেছি। আমি আশা করি তাকে দেখে বাংলাদেশি কমিউনিটির আরোও অনেকে সামাজিক ও পরস্পরকে সহযোগীতা করে আমাদের কমিউনিটিকে আরো উপরে নিয়ে যাবেন। আমরা তার আরো উন্নতি কামনা করছি।
সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সোসাইটি(এসবিএস) ও বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বার অব সিঙ্গাপুরের(বিডিচেম) সভাপতি মির্জা গোলাম সবুর, বলেছেন, সিঙ্গাপুরে লকডাউনের সময় নিঃস্বার্থ ভাবে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য এগিয়ে এসেছেন তিনি। এজন দূর্যোগ সময়ে তার এই অবদান একদিকে যেমন প্রশংসার যোগ্য তেমনি দৃষ্টান্তমূলক। আমি অত্যান্ত খুশি যে একজন বাংলাদেশি বংশোভূত সিঙ্গাপুরিয়ানকে সিঙ্গাপুর সরকার প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড দিয়ে সম্মান দিয়েছেন। কবির হোসেনকে আমি আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এখানকার সুধি সমাজ ও বিজনেজ কমিউনিটি তার এই মহৎ কর্মের উদাহরণ অনুসরণ করবেন বলে সেই আশা করি। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
সাহিদ গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এসবিএস ও বিডিচেম এর সাবেক সভাপতি সাহিদুজ্জামান টরিক বলেন, সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশি ভাই কবির হোসেনের প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড বাংলাদেশের কমিউনিটির জন্য বিরল অর্জন । প্রবাসীদের জন্য এটি অত্যান্ত আনন্দের ও গর্বের সংবাদ। আমি মনে করি কবিরকে দেখে অন্যান্য বাংলাদেশিরা অনুপ্রাণিত হয়ে উৎসাহিত হবে। কবির সমস্ত বাংলাদেশিদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সিঙ্গাপুরে সমস্ত বাংলাদেশিকে আজ গর্বিত। আমরা তার জন্য গর্ব করি।
সিঙ্গাপুরে একটি বহুজাতিক তেল কোম্পানিতে কর্মরত ও এসবিএসের সাবেক সভাপতি রফিকুল কাদের বলেন, মানবসেবার জন্য প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাওয়াতে আমরা বাঙ্গালি কমিউনিটি অত্যান্ত আনন্দিত ও গর্ব বোধ করছি। তিনি লকডাউনের সময়ে ডরমিটরিতে আটকেপড়া প্রবাসী শ্রমিক ভাইদের খাদ্য সমাগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে যথেষ্ট কাজ করেছেন। তার এই মানবিক কারণে তিনি আজ স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই স্বীকৃতি সকল বাংলাদেশির জন্য গর্বের বিষয়। আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
সোসিয়েট ডিরেক্টর সিবিআরই, রিজিওনাল হেড অব স্ট্রাটেজি- সাউথ ইস্টি ও সাউথ এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে কর্মরত এএইচএম সাইফ হোসেন বলেন, কবিরের সফলতার রূপকথাটি হলো পরিশ্রম সততা আর পরোপকারের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে কবির। আমরা যারা বাঙালি বাংলাদেশি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছি, আমারা একেকজন বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর। আমাদের এই পরিচয়কে আজ কবির অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। ওর জন্য শুভ কামনা।
করোনা ভাইরাসের মহামারিতে নিজের অর্থায়নে ও নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় স্ত্রী নূরিয়া বেগমকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে লকডাউনে আটকে পড়া অভিবাসী শ্রমিকদের মাঝে বিনামূল্যে খাদ্য ও নিত্য পণ্যসামগ্রী বিতরণ করে আলোচনায় আসেন তিনি। এসময় রমযান মাসে বিভিন্ন শ্রমিক ডরমিটরিতে ইফতার সামগ্রী বিরতণ করেন। তার এই মহৎ উদ্যোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।
এমন দুর্যোগময় সময়ে অভিবাসী শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা ও দুর্ভোগ লাগবের কথা চিন্তা করে BCS.SG.WAY নামে অ্যাপস চালু করে। এতে করে সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকরা অ্যাপস ব্যবহার করে নিত্য পণ্যসামগ্রী অর্ডার করে ন্যায্যমূল্যে ফ্রি ডেলিভারিতে সহজেই ঘরে বসে তা সংগ্রহ করতে পারছেন। এতে শ্রমিকদের অর্থ সাশ্রয় ও সময় অপচয় অনেক কমে যায়।
সিঙ্গাপুরে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। বিশেষ করে এই অ্যাপস ব্যবহার করে বাংলাদেশী অভিবাসীরা খুব সহজে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন, নবায়ন করতে পারছেন কোন প্রকার ঝামেলা দুর্ভোগ ছাড়াই । বেকার, অভাব ও বিপদগ্রস্ত শ্রমিক অ্যাপসের মাধ্যমে সাহায্য আবেদন করতে পারেন। এছাড়াও আরো কিছু সুবিধাজনক সার্ভিস যুক্ত রয়েছে।
কবির হোসেন এমন ক্রিয়েটিভিটি অ্যাপস তৈরি করে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনযাত্রাকে সহজ সহায়ক করে তোলা, করোনার দুর্যোগ সময়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো ও তরুণ সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সিঙ্গাপুর সরকারের নজরে আসলে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেয়ার জন্য তাকে মনোনীত করা হয়। প্রতিবছরের মত সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন বিষয়ে অবদান রাখার জন্য দুইশত ব্যক্তির মধ্যে ৪৫ জনের শর্টলিস্টে তার নাম আসে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে তাকে অ্যাওয়ার্ডের কথা নিশ্চিত করেছিলেন।
ব্রুকলিনজ স্টেইনলেস স্টিল প্রাইভেট লিমিটেড ও এসজি ওয়ে পিটি লিমিটেডের সিইও কবির হোসেন ১৯৮১ সালের ৪ঠা জানুয়ারিতে কুমিল্লা জেলার চান্দিনার সাইকোটে জন্ম । বাবা আবদুল গফুর, মা তুরা বেগম। দুই বোন দুই ভায়ের মধ্যে সবার বড় কবির হোসেন। ছোট ভাই কাউছার আহমেদ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সিঙ্গাপুরে থাকেন। স্ত্রী নূরিয়া বেগম সিঙ্গাপুরিয়ান ভারতীয় বংশোভূত মুসলিম। ৫ বছরের এক ছেলে আমির ইহসান এক মেয়ে যোয়াকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের বেন্ডামিরে বসবাস করছেন।
চান্দিনা পাইলট হাই স্কুল থেকে ১৯৯৭ সালে এসএসসি,চান্দিনা রেদোয়ান আহমেদ ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ২০০০ সালে সিঙ্গাপুরে জীবিকার সন্ধানে আসেন। একটি স্টেইনলেস স্টিল কোম্পানিতে সাধরণ ওর্য়াকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে পরিশ্রম, মেধা আর সততা দিয়ে একই কোম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখা করে সিঙ্গাপুরের সার্টিফাইড সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।
চাকরি জীবনে সীমাবদ্ধতা, অনিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে ২০১২ সালে স্বল্প পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় একটি ফ্যাক্টরির অংশবিশেষ ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। পরে সততা আর পরিশ্রম দিয়ে ধারাবাহিক সাফল্য আসায় আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাকে। বর্তমানে তার নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে সিঙ্গাপুরিয়ান,ফিলিপিনো, বাংলাদেশী মিলিয়ে ২১ জন কর্মরত রয়েছেন।
সিঙ্গাপুরের একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে জার্মান, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশে ওভারসিজ বিজনেস ওর্য়াকশপ করেছেন তিনি সিঙ্গাপুর সরকারের এজেন্সির মাধ্যমে। ছেলে ইহসানের নামে ইহসান ফাউন্ডেশন করে ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশে অনাথ অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মানুষদের অর্থ সহায়তা ও গৃহহীনদের ঘর তৈরি কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
এছাড়া ব্রুকলিনজ কমিউনিটি সাপোর্টের প্রতিষ্ঠাতা তিনি যা সিঙ্গাপুরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে।পরিবারকে নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন অবসরে গল্ফ,ব্যাডমিন্টন খেলতে পছন্দ করেন।কবির হোসেনের জীবনের লক্ষ্য ভালো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা, আল্লাহর সমস্ত আদেশ মান্য করা এবং তাঁর সমস্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা।